আসাদুজ্জামান সম্রাট, এম এম লিংকন: [৩] বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী (ডামি প্রার্থী) হিসেবে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে নতুন কৌশলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। শক্ত বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই মাঠে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সরকারের অনেক মন্ত্রী ও এমপিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী। প্রায় অর্ধেক আসনেই প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে ১২০টি আসনের ফলাফল কী হবে তা আঁচ করার সুযোগ নেই। নতুন এ কৌশলের কারণেই মাঠ পর্যায়ে একতরফা নির্বাচনের পরিবেশ পাল্টে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

[৪] একজন প্রার্থীর মৃত্যুতে নওগাঁর একটি আসনের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। ২৯৯টি আসনে ১ হাজার ৯৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন।

[৫] আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। তৃতীয় লিঙ্গসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

[৬] ২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি। নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন। 

[৭] দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।

[৮] প্রধান বিরোধী শক্তি নির্বাচনে না থাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংসদের তিন শত আসনের মধ্যে দুই শতাধিক আসন নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বলে অনেকটা নিশ্চিত। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদসহ চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। রোববারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পঞ্চমবারের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে বিরোধী দল কে হবে তা নিয়ে রয়েছে আলোচনা। 

[৯] বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের কোন প্রার্থী না দিলেও সেখানে রয়েছে আওয়ামী লীগের শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাই জাতীয় পার্টি ২৬টি আসনে জয়ী না-ও হতে পারে। এবারের নির্বাচনে ৩০ থেকে ৪০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেন। সেক্ষত্রে সরকার সমর্থিত নতুন দুটি দল তৃনমুল বিএনপি ও বিএনএম যদি জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দলে ভিড়িয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ে বেশি আসন পায় তাহলে বিরোধী দলের মর্যাদা হারাতে পারে বর্তমান বিরোধী দল। তবে শেষ পর্যন্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটা প্রলেপ রাখতেই জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে বেছে নেওয়া হতে পারে। যেমনটি হয়েছিল ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। 

[১০] এদিকে ভোট ঠেকাতে ভোটারদেরকে ভোট দিতে না যাওয়ার আহবান জানিয়ে বিএনপি শনিবার ও রোববার সারা দেশে হরতাল ডেকেছে। এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিরোধী দলের হরতালের মধ্যে। নির্বাচনের একদিন আগে একটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জনমনে শঙ্কা রয়েছে। অনেক যানবাহন ও ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। নাশকতামূলক এসব কর্মকাণ্ডে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

[১১] নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণসহ ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়ে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়ার জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলা ভোলা ও বরগুনা সর্বমোট ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সাথে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্র সমূহে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করবে।

[১২] এই নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য আইনশৃংখলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প¬াটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারাদেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একইসাথে মাঠে কাজ করছে বিজিবি’র বিশেষায়িত ফোর্স র‌্যাপিড এ্যকশন টিম (র‌্যাট)। এছাড়া বিজিবি’র কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবি'র অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা রাখে।

[১৩] নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে। এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে কোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করেছে। 

[১৪] নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হবে।

[১৫] সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলেও এ নির্বাচনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে নির্বাচন কমিশন। বিশাল এ বাজেটের বেশির ভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এই ব্যয় এ যাবতকালে অনুষ্ঠিত যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি। সম্পাদনা: ইকবাল খান,  সালেহ বিপ্লব